চীনে একটা জনপ্রিয় প্রবাদ আছে—“অফিসাররা সংখ্যাগুলো তৈরি করে, আর সেই সংখ্যাগুলোই অফিসারদের তৈরি করে।” আর এই কথাটা সবচেয়ে সত্যি যে জায়গাটায়, সেটা হচ্ছে জিডিপি—সেই চকচকে পরিসংখ্যান যা দেখায়, দেশের অর্থনীতি কতটা “সুস্থ”। কিন্তু বাস্তবতা? অনেকটা গানের মত—তাল আছে, কিন্তু কথা নেই। চীনের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বহু বছর ধরে এমনভাবে নির্ভরযোগ্যভাবে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে যে, সেটাকে জাদু না বলে উপায় নেই। 6.9%, 6.5%, 6.0%—যা চাইবেন, সেটাই ঘোষণা হয়।
তবে সমালোচকরা বলছেন, এই জিডিপি আসলে “মানব-নির্মিত”—অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতার অর্থে নয়, বরং সৃজনশীল হিসাববিজ্ঞানের ফাঁদে! এমনকি চীনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং পর্যন্ত স্বীকার করেছেন, চীনের সরকারি জিডিপি তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাই তিনি একটা বিকল্প সূচক ব্যবহার করতেন—বিদ্যুৎ খরচ, রেলপথে মালবাহী ট্রাফিক, ও ব্যাংক ঋণের সমন্বয়ে তৈরি ‘লি কেকিয়াং ইনডেক্স’। যখন দেশের শীর্ষ নেতা নিজের দেশের হিসাবকে বিশ্বাস করেন না, তখন বোঝাই যায়, গলদটা কতটা গভীরে।
সংখ্যার খেলায় কারসাজি: কেন ও কিভাবে
বিপুল আর জটিল সাম্রাজ্য
চীনের মতো এক বিশাল অর্থনীতিতে জিডিপি পরিমাপ করাটাই বিশাল চ্যালেঞ্জ। তার উপর যখন স্থানীয় অফিসারদের প্রমোশন নির্ভর করে জিডিপি বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ওপর, তখন শুরু হয় ‘সংখ্যা বানানোর’ খেলা।
বেইজিং যেমন বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে (ধরুন ৭%), তা নিচের স্তরে পৌছায়—প্রদেশ, শহর, জেলা—সবাই নিজের নিজের লক্ষ্য ঠিক করে: “আমরা ৯% করব!” যার ফলে, প্রমোশনের লোভে শুরু হয় সংখ্যার কারসাজি। কেউ অপ্রয়োজনীয় হাইওয়ে বানায়, কেউ ফাঁকা কারখানা নির্মাণ করে, কেউ আবার সোজাসুজি ডেটা বানিয়ে ফেলে।

২০১৭ সালে লিয়াওনিং প্রদেশ স্বীকার করেছিল, ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তারা প্রায় ২০% জিডিপি সংখ্যা বানিয়ে দিয়েছে। এরপর ইনার মঙ্গোলিয়া ও তিয়ানজিনও স্বীকার করেছিল একইরকম জালিয়াতির কথা।
মেক-আপ দিয়ে মেক-শিফট বৃদ্ধি: কোভিড আর জাদুকরী পরিসংখ্যান
২০২০ সালে যখন বিশ্বজুড়ে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ল, চীন ঘোষণা করল, তারা ২.৩% হারে বৃদ্ধি পেয়েছে! অনেক বিশ্লেষক তখনই বলেছিলেন, ব্যাপারটা “মসৃণ করে তোলা”—মানে, আসল সংখ্যা ঝাঁজালো হলে, একটু পালিশ করে উপস্থাপন করা। কোথাও ইনফ্লেশন কম দেখানো, কোথাও ডেটা ডিফ্লেটর বদলানো, কোথাও রিপোর্টই বন্ধ করে দেওয়া (যেমন ২০২৩ সালে তারা হঠাৎ যুব বেকারত্ব বা ভোক্তা আস্থার ডেটা দেওয়া বন্ধ করে দেয়)। এভাবে তৈরি হয় “অফিসিয়ালি সাজানো বাস্তবতা”।
অন্ধ বিশ্বাসের ঝুঁকি: নিজের হাইপে নিজেই ডুবে যাওয়া
এইসব ডেটা ফাঁকি শুধু একটা সংখ্যার খেলা নয়—এর গভীর প্রভাব পড়ে নীতিনির্ধারণ, আন্তর্জাতিক আস্থা, ও দেশের ভিতরে আত্মবিশ্বাসে।
১. নীতির ব্যর্থতা:
যখন বেইজিং ভুয়া ডেটা পায়, তখন ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। ঠিক মতো প্রণোদনা দেয় না, সংকটের গভীরতা ধরতে পারে না, বা অপ্রয়োজনীয় মেগা-প্রজেক্টে বিনিয়োগ করে। ফলাফল? ঋণের পাহাড়, ভূতের শহর, আর হারানো সুযোগ।
২. আন্তর্জাতিক আস্থার পতন:
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এসব ‘পরিসংখ্যান-সমস্যা’ জানে। অনেকে সতর্ক থাকে, কেউ কেউ ডিসকাউন্ট রেট দিয়ে হিসাব করে। যখন সরকারি পরিসংখ্যানই বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন তা শুধু অস্বস্তি নয়—বিশ্বাসহীনতা তৈরি করে। ভবিষ্যতে যদি চীন বৈদেশিক ঋণ বা সহযোগিতা চায়, এই বিশ্বাসঘাটির মাশুল দিতেই হবে।
৩. নিজের ফাঁদে নিজেই:
যে অফিসার সংখ্যার কারসাজি করেছেন, তিনিই পরে পড়েন দোটানায়—বাস্তব সংখ্যা দিলে তা আগের ভুয়া বৃদ্ধির তুলনায় কম দেখায়, আর সে ‘ব্যর্থতা’ হিসেবে গণ্য হয়। তাই পুরনো ভুল চালিয়ে যাওয়া হয়। ফলে প্রকৃত সমস্যা ধামাচাপা পড়ে থাকে—যতক্ষণ না সেটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
জিডিপি পড়ুন, কিন্তু চোখ খুলে: বিকল্প সূচকগুলো দেখুন
বিশ্লেষকরা এখন অনেক বিকল্প সূচকে ভরসা রাখছেন—
- বিদ্যুৎ ব্যবহার: উৎপাদনের প্রকৃত ইঙ্গিত দেয়।
- রেল মাল পরিবহণ: পণ্য উৎপাদন হলে পরিবহনও হবে—সেটি না হলে সন্দেহ।
- রাতের উপগ্রহ চিত্র: রাতে শহর আলোয় ভরে গেলে তা অর্থনৈতিক সক্রিয়তার ইঙ্গিত দেয়।
- আয়কর ও ভ্যাট: বেশি জিডিপি দাবি করলে আয়করও বেশি আসা উচিত—না এলে সন্দেহ।
ভারতের জন্য পাঠ: স্বচ্ছতা হোক প্রতিযোগিতার অস্ত্র
চীনের এই ‘সংখ্যার বিভ্রম’ ভারতের জন্য এক শিক্ষা। যতক্ষণ না পর্যন্ত ভারত তার পরিসংখ্যান স্বচ্ছ রাখে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটি হবে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে এক প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা।
ভারতের নিজস্ব কিছু ডেটা বিতর্ক সত্ত্বেও, এখানে খোলা আলোচনা ও পদ্ধতির স্বচ্ছতা রয়েছে। ভবিষ্যতে যদি চীন আর্থিক সংকটে পড়ে ও বৈদেশিক বন্ড বিক্রি করতে চায়, তখন এই বিশ্বাসহীনতা তাদের পিছিয়ে দেবে।
আরেকটি আশঙ্কা—যদি চীনের অর্থনীতি ভেতরে থেকে দুর্বল হয়, তাহলে তা রাজনৈতিকভাবে আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে। কারণ, অর্থনৈতিক সাফল্যের বদলে জাতীয়তাবাদ দিয়ে জনসমর্থন অর্জনের চেষ্টা করতে পারে। তাই এই বিভ্রমের মুখোশ খুলে দেওয়াটা শুধু পরিসংখ্যানগত চ্যালেঞ্জ নয়, এটি একটি ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা।
উপসংহার: আয়নার দোষ নয়—নিজেকে চিনুন
চীনের জিডিপি অনেক সময় যেন আয়নার ঘরে দাঁড়ানো—একটা প্রতিচ্ছবি আছে, কিন্তু সেটা পুরো সত্য নয়। ম্যাজিক চলতে পারে কিছুক্ষণ, কিন্তু সত্য একসময় ধরা দেয়।
চীনের সামনে এখনকার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—“যে করেই হোক বৃদ্ধি চাই” মনোভাব থেকে সরে এসে “স্বচ্ছ, স্থায়ী ও গুণগত বৃদ্ধি”তে আসা। কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে—পুরনো ডেটা সংশোধন, কেন্দ্রীয়ভাবে রিপোর্ট সংগ্রহ ইত্যাদি—but old habits die hard.
তাই যখন আপনি শুনবেন, “চীনের জিডিপি এবার ৫.৫% বেড়েছে”, মনে মনে একটা ছোট্ট অ্যাস্টেরিক্স দিয়ে রাখুন—সেটা হয়তো ৪.২%, বা ৬.১%—তবে তার থেকেও বড় কথা হলো, আসল গল্পটা সংখ্যার আড়ালে কোথায় লুকিয়ে আছে।
সত্যিটাই শেষমেশ টিকে থাকে—কোনও পরিসংখ্যানের সাজানো মুখোশ নয়।
🎯 আরও পড়ুন: শি জিনপিং-এর অর্থনৈতিক অস্থিরতা — চীনের শান্ত চেহারার পেছনের গোপন সংকট