পরিচিতি: এক পূজার শহর আগুনের কাছে আত্মসমর্পণ করল
১০১৮ খ্রিষ্টাব্দে শীতকালে, শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি ও ভারতীয় সভ্যতার এক মণিকোঠা—মথুরা—এক ভয়ের অতল নিমজ্জিত হলো। তা কোনো রোগ নয়, না কোনো খরা। এটি ছিল গজনির মাহমুদ—বিশ্বাসের সম্মোহন গৌরব নিয়ে লুটপাটে তৎপর।
মাহমুদের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক অভিযান কেবল ধনলুটই ছিল না, এটি ছিল এক সভ্যতার মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলার প্রচেষ্টা—মন্দির, সংস্কৃতি ও স্মৃতিকে লক্ষ্য করে।
সহজে টেক্সটবুকের এক-লাইনে সীমাবদ্ধ হওয়া যায়, কিন্তু মথুরাবাসীরা তা ভুলে যায়নি। আজও স্মৃতির আঁচলে টিকে আছে।
মথুরা আগুনের পূর্বে
আগুনে যখন শহর গ্রাস করল, তখনও মথুরা ছিল তা শুধু একটি নগরীর চেয়েও অনেক বেশি।
এটি ছিল এক আধ্যাত্মিক কেন্দ্র, শতাব্দী ধরে শ্রদ্ধার স্থান। এখানে ছিল শত শত মন্দির, বিশাল জনসভা শালা, গ্রন্থাগার ও তীর্থ উৎসব—যা সারাদেশ থেকে লোকদের আকর্ষণ করতো। মথুরা ছিল ধারাবাহিক বিশ্বাস ও ভক্তির প্রতীক।
আল-উতবির ‘তারিখ-ই-যামিনী’ অনুসারে, মথুরাকে কেন্দ্র করে ছিল সোনার ও রূপার মূর্তি, এবং প্রতিটি বাড়িতেই ছিল একটি মন্দির।
মাহমুদের আগমন: তরোয়ার হাতে, আল্লাহ বানান গলায়
গজনির মাহমুদ ইতিমধ্যে ইসলামীয় লুটপাটের এক সুপরিচিত নাম হয়ে উঠেছেন। থানেশর, মথুরা ওসমনাথে তার আগেও অভিযান হয়েছিল; কিন্তু মথুরাটি আলাদা।
সোনা-রূপার ঝলমলে মন্দিরগুলোর জন্য মাহমুদ যেন বিমোহিত হয়েছিল। প্রতিটি মন্দির—মন্দির নয়, যেন ঝংকার শোনা যায় এমন ব্যাংক।

সবচেয়ে বিধ্বংসী অভিযান শুরু হলো
তখন যুদ্ধ নয়—শুধু ধ্বংস আর বিলুপ্তি।
তরোয়ারে সজ্জিত সৈন্যদল মথুরায় ঢুকেছিল যেন মরুভূমির আগুন।
মন্দিরগুলো থেকে প্রতিটি পাওয়া তাবিজ, সোনা, মূর্তি সংগ্রহ করে পানি উচ্ছিষ্ট করে ছুড়ছিল।
হাজার বছরের প্রাচীন শৃঙ্গারসহ মন্দিরগুলি তুলনা করে ফেলা হল।
প্রতিটি ঘর জ্বলতে লাগল ইংরেজিতে ‘grand Vishnu temple’ হিসেবে পরিচিত সেই মন্দির।
যারা পালাতে অস্বীকৃতি জানাল, তাদের ব্রাহ্মণদের হত্যা করা হল।
আল-উতবি অভিযোগ করলেন: “শহর এত সম্পদে পূর্ণ ছিল যে লুট করার জন্য ১০০ টি উটও কম ছিল না।”
মহিলাদের দুর্ভোগ : মানবতাবিরোধী অপরাধ
একটিই ঘটনা ছিল না—এটি এক সভ্যতাগত ধ্বংসযজ্ঞ।
– পূজারত হলে প্রার্থনার মাঝেই পুজারি নিহত।
– মহিলাদের যৌনদাসী হিসেবে নিয়ে যাওয়া হলো।
– সশিশু শিশুদের বাজারে বিক্রি করা হলো—গজনি থেকে পারস পর্যন্ত।
ইতিহাসবিদ উইল ডুরান্ট পরবর্তীতে লেখেন,
“ইসলামী আক্রমণ ভারতে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত অধ্যায়।”
মথুরা ছিল সেই ইতিহাসের প্রথম খণ্ডন।
প্রতিরোধ কোথা?
ক্ষুদ্র রাজপুত সংঘগুলো উঁচু দুর্গ পাহারা দিতে শনৎ কিন্তু কোথাও স্ট্যান্ডিং আর্মি দেখা গেল না।
লোকালরা মুদির লুকিয়ে রাখল, মহিলাদের পলালেও সাহায্য করতে পারেনি।
রাজনৈতিকভাবে উত্তর ভারত তখন ভগ্নাবশেষ—রাজা-রাজার দ্বন্দ্ব৷ আর ধর্মীয় অভিযানের ঝড় উপমুখে।
ধনলুটের চাইতে বড় বিষয়: ভয় ও মনস্তাত্ত্বিক জয়
হ্যাঁ, সে কোটি কোটি সোনা-রূপা লুটে গেল।
কিন্তু মাহমুদের প্রকৃত জয় ছিল মনস্তাত্ত্বিক—ভয় সৃষ্টি,
– যে কোনও শহরই আক্রমণের নাগালের বাইরে নয়,
– যে বিশ্বাস সশস্ত্র সুরক্ষা ছাড়া সম্ভাব্য নয়,
– তাই দেশের সাংস্কৃতিক ভরতাকে শ্বাসরোধ।
আল-উতবির ‘তারিখ-ই-যামিনী’ অনুসারে
“আমি মথুরা পুড়ে রেখেছি—একটুখানি অবশিষ্ট ছিল না।”
সূত্রসমূহ 📘📗📙
- ‘তারিখ-ই-যামিনী’, আল-উতবি—গজনির অফিসিয়াল ইতিহাস, মন্দিরাতঙ্ক ও ধ্বংসের বর্ণনা।
- ‘ইতিহাস ও সংস্কৃতি অব দ্য ইন্ডিয়ান পিপল’, আর.সি. মজুমদার—মহাজাগতিক কারণে মাহমুদের মোকাবিলা ও ধ্বংস সাধনের অবরুদ্ধ ইতিহাস।
- ‘দ্য স্টোরি অব সিভিলাইজেশন’, উইল ডুরান্ট—মাহমুদের অভিযানের আদর্শগত সহিংসতার বিশ্লেষণ।
মাহমুদের রেখে যাওয়া: ধ্বংস নয়, হাস্যর মতো প্রতিবাদ
যুদ্ধের পরে মন্দির ভস্মে পরিণত, গ্রন্থাগার ধূলিতে।
কিন্তু মথুরার লোকেরা হার মানেনি।
বেঁচে থাকা মানুষ অন্য শহরে আশ্রয় নিলেন।
ভক্তি কবিরা মথুরার চেতনা গাথনা করে কবিতায় তুলে ধরলেন।
শহর হারায়নি—বই, স্মৃতি ও সংস্কৃতির মধ্যদিয়ে ফিরে এসেছে নতুন আকারে।
সারাংশ
সারাংশ
মাহমুদের মথুরায় লুটপাট শুধু অর্থলিপির ঘটনা নয়, এটি ছিল এক সভ্যতাকে লঙ্ঘনের নির্দেশিকা—ঐক্য, বিশ্বাস, শিক্ষা ও নারীকে অপমানিত করে করা এক চেকলিস্ট।
কিন্তু মথুরা মৃত্যুবরণ করেনি। এটি সময়ের হাত ধরে ফিরে এসেছে—তোষণের চেয়ে প্রগাঢ়, পুনর্জন্মের মুখে মহন্ত।
এই আক্রমণগুলো আলাদা কোনো ঘটনা ছিল না—এগুলো ছিল ভারতের সভ্যতাগত ধারাবাহিকতাকে ধ্বংস করার পরিকল্পিত অভিযান।
শেষ কথা: মাহমুদের সবচেয়ে বিধ্বংসী অভিযান ছিল না শেষ—এটি ছিল একটি ব্লুপ্রিন্ট
আপনি যদি ভাবেন মথুরায় মাহমুদের হামলা শুধুই লুটপাটের জন্য ছিল, তাহলে আরেকবার ভাবুন। এটা ছিল ভবিষ্যতের আক্রমণকারীদের জন্য একটি নির্দেশিকা। একটি চেকলিস্ট।
তাদের দেবতাদের ভেঙে দাও।
তাদের পুস্তক পুড়িয়ে দাও।
তাদের নারীদের অপমান করো।
তাদের আত্মবিশ্বাস চূর্ণ করো।
ঘোরি থেকে বাবর—সব পরবর্তী আক্রমণকারী মাহমুদের পথ অনুসরণ করেছে।
কিন্তু মথুরা?
সে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। বারবার।
কারণ ভারত ভুলে না।
আর যা পবিত্র, তা কখনও মরে না—তা ফিরে আসে, আগের চেয়ে আরও প্রবল কণ্ঠে।