শি জিনপিং যখন কথা বলেন, তখনই আপনি শুনতে পাবেন—চীন অর্থনীতির ইঞ্জিনরুমে খড়কুটোর ক্ষুদ্র শব্দ। প্রকাশ্যে তিনি আত্মবিশ্বাসী—জিডিপি লক্ষ্যমাত্রায় অগ্রসর এবং “অর্থনীতি স্থিতিশীল ও উন্নয়নের পথে।” কিন্তু তার বক্তব্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ইঙ্গিতগুলো সতর্কতার ছবি ফুটিয়ে তোলে: অর্থনৈতিক ঝড় আসছেন, এমন ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বাগাড়ম্বরহীন সতর্কতা প্রকাশ করছেন।
রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যেখানে সরল সত্য প্রকাশে প্যানিক ছড়াতে পারে—শি এই বার্তাগুলো যুগপত সরলীকৃত প্রসঙ্গ ও উপমার আড়ালে গোপন করছেন—“কালো রাজহাঁস” বা “ধূসর গণ্ডার” ব্যবহার করে, “মন্দা” বা “সংকট” সংক্রান্ত শব্দগুলি এড়িয়ে।
আশাবাদীর দেয়ালের ফাটল
সরকারি ভাষায় শি জিনপিং বলেন—চীনের অর্থনীতি দৃঢ় এবং উন্নয়নের পথে। ২০২৪ সালের নববর্ষ ভাষণে তিনি বলেছিলেন—“অবুঝ হাওয়ার” মুখে দাঁড়িয়েও অর্থনীতি ২০২৫ সালে ৫% বৃদ্ধির দিকে অগ্রসর থাকবে। কিন্তু সেই বক্তব্যেও তিনি “বহিরাগত অনিশ্চয়তা” ও “উন্নয়নের গতির পরিবর্তন চাপ” উল্লেখ করেন। অর্থাৎ—রপ্তানি স্থবির, প্রথাগত রিয়েল এস্টেট–ইনফ্রা মডেল অবসন্ন, দ্রুত নতুন বৃদ্ধির ইঞ্জিনের প্রয়োজন।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে কম্যুনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর বৈঠকেও “দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ উদ্দীপনামূলক প্রতিশ্রুতি” দেওয়া হয়—অর্থনৈতিক উদ্দীপনায় নজিরবিহীন ঘুর্ণি। এই ভঙাটিই ছিল নীতিমালার অ্যালার্ম।

সতর্কতার আরও নিদর্শন
শি ও তাঁর সহযোগীরা “কালো রাজহাঁস” ও “ধূসর গণ্ডার” উল্লেখ করে—যা অর্থনৈতিক ঝুঁকি ও অবহেলিত সংকটের ইঙ্গিত। ২০২৫ সালের শুরুতে চিনা ভাব-চিন্তা প্রতিষ্ঠান থেকে দুর্বল পরিস্থিতি নিয়ে রাষ্ট্র মাধ্যমে বিস্তৃত আলোচনা হওয়া ইঙ্গিত দেয় শীর্তির চরিত্র—“অনিশ্চয়তার” ভ্যাকসিন পেতে হবে জনগণকে প্রস্তুত করতে।
নিবিষ্ট স্বপ্নহীনতা: যুব বেকারত্বের গোপন ডােটা
২০২৩ সালের মাঝামাঝি যখন যুব বেকারত্ব আবার ২১% ছাড়িয়ে যায়, সরকার ডেটা প্রকাশ বন্ধ করে দেয়—এক স্পষ্ট সংকেত যে, “অসংযত সত্য” লুকানো হচ্ছে। অন্যথায়, হঠাৎ প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া হত না।
ডেটা ব্ল্যাঙ্ক আউট কয়েক মাস স্থায়ী ছিল—এতে বোঝা যায়: “করা হলে না, দেখানোও কঠিন।” ২০২৪–এর শেষ দিকে ছাত্রদের বাদ দিয়ে ডেটা আনতে গিয়ে বিড়ম্বনা এড়াতে ভিন্ন মাত্রা দিয়ে তথ্যে “-কর্তৃত্বাধীন স্বস্তি” ছড়িয়েছিল।
শি-র অর্থনৈতিক উওয়ারে কী পদক্ষেপ নেয়া হলো
২০২৩–২৪ সালে নীতিমালার ধারাবাহিক পরিবর্তন স্পষ্ট করে তোলে—জমির দাম পতনের প্রতিশোধ, তারপর হঠাৎ কর ছাড় ও সুদের হ্রাস চালু। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে “সাধারণ সমৃদ্ধি” অভিযান থেকে ক্ষতিপূরণ দিতে শুরু করল আরেকবার। শেষতমেঁ ২০২৪–এর শেষভাগে বড় উপবৃত্তি দেওয়া হলো অর্থনীতিতে—“মনোযোগী জলাবদ্ধতা প্রয়োগ”, যা ২০০৮–এর পর সর্বোচ্চ মানসিক উৎসাহ দিয়ে অর্থনীতিতে অর্থ ঢোকানো।
যদি সবনেতা মেজাজ “ফুলেফিল” টাইম, তাহলে কেন এই জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া হলো? কারণ “অজানা সংকট”, “কম খরচ, কম বিক্রি”, “স্থানীয় সরকারের ঋণ-ভাঙা অবস্থা”—এই বিষয়গুলো ভয়ানক বাস্তবে।
চীনের দানবসম হুমকি: শি কেন নীরব চিন্তায় রয়েছেন?
১. রিয়েল এস্টেট সংকট: অতিরিক্ত নির্মাণ, ঋণগ্রস্ত ডেভেলপার—এর দৈর্ঘ্য সারাদেশে খালি শহর, প্রতারিত আস্থা। ২০২১–এর ইভারগ্রান্ড ঋণ সংকটটি মাত্র শুরু—বাসা বিক্রি–মূল্য–রাজস্ব–সরকারী সংকট নিয়ে ভুগছে, তাই সরকার অকপটে বন্ধ করে দেয়নি, বরং হোমলোআন দেয়ার নির্দেশ দিল।
২. জনসংখ্যার সংকট: ২০২২ সালে জনসংখ্যা প্রথমবার হ্রাস পেল ৬০ বছরের বেশি সময়ে—প্রতি নারীকেই জন্ম দেয় ১.২ জন সন্তান—গবেষণায় পড়েছে। বিবাহ–জন্ম–উপেক্ষিত চলছে। বর্তমানে “মধ্যবিত্ত ফাঁদে” আটকে পড়া রোধে জনবাস্তু নীতিনির্ধারণে রাজনৈতিক বৈঠক—সচরাচর ভিন্ন, এবার সরাসরি উল্লেখ করা হলো “গুরুতর জনসংখ্যাগত চ্যালেঞ্জে”।
৩. আত্মবিশ্বাসের সংকট: প্যান্ডেমিক–পরবর্তী সস্ত্রীক “উদ্দীপনামূলক অর্থনৈতিক প্রত্যাশা” দ্রুত শেষ। ২০২৪–এর মাঝামাঝি থেকে ব্যয়–খরচ–উদ্দোক্তারা থেমেছে। শি–র মুখে দেখা যায়: উচ্চ–পদস্থ অর্থনৈতিক–উদ্যোক্তা–CEO সমাবেশ – নেতাদের বিনিয়োগ ও নিয়োগে আহ্বান—সক্ষম গবেষণার প্রমাণ যে, “আর্থিক আত্মবিশ্বাসে–চিন্তা–কমেছে”।
শির “অগ্রাহ্যতা”—গ্রহণযোগ্য কিন্তু অস্পষ্ট
শি–র কাছে খানিকটা স্বচ্ছতা আছে—যথেষ্ট বেশি নয়। সরকারের প্রথম পদক্ষেপ ছিল—“নিয়ন্ত্রিত স্বচ্ছতা” বজায় রাখা—অল্প পরিমাণ সমস্যার কথা জানিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া, যাতে জনগণ প্যানিক না করে।
যুব বেকারত্ব–ডেটা সম্বন্ধে পুলিশ–নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া প্রচার—“কর্মসংস্থানের মহত্ত্ব” বার বার প্রকাশ, জনগণকে “রাগ শোধে নিজস্ব প্রয়াস” উদ্বুদ্ধ—নিহিত অর্থে “যুবসমাজকে আত্মকষ্ট থেকে উত্তরণে স্বাবলম্বী হবার আহ্বান”।
ছোট বিবেচিত আন্দোলন—যেমন বাড়িঘর–সংলগ্ন অবকাঠামোর বোতল–সঙ্গে – সরকার নির্বিঘ্নে কিছু আপস করেছে, সাথে–নিয়ন্ত্রণ ও গ্রেপ্তার শুরু করেছে। বার্তা স্পষ্ট — “আমরা শুনছি—কিন্তু খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ না করার অনুরোধ।”
জাতীয়তাবাদ—এক চাপ নিঃসরণ ধারা
অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে—রাষ্ট্রীয় মিডিয়া জাতীয় নেতিবাচকতা এড়িয়ে—তাই গুরুত্ব দিল অপেক্ষাকৃত বর্দ্ধিত কিছু “বিদেশী হুমকি” বা “বহির্বিশ্ব গর্ব” বিষয়ে। যেমন—২০২৩–এ তাইওয়ান, মার্কিন–চীণ বাণিজ্য দ্বন্দ্ব, মহাকাশ–প্রযুক্তিতে সাফল্য। কিছুদিন “ভিলেন” খুঁজে বের হয়—মার্কিন–বুলিং নামে “উজ্জ্বল উদ্দিপনামূলক মনস্তাত্ত্বিক–আবহ” তৈরি করে।
দুর্নীতিবিরোধী অভিযান—রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার
অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রতিপক্ষের ভাঙন রোধে—শি “দুর্নীতির বিরুদ্ধে” অভিযানে—দলীয় নেতাদের অপসারণ করে ক্ষমতাবান নেতা ধরে রেখেছেন। এই শৃঙ্খলা সামাজিক–রাজনৈতিক–সঞ্চালন–হ্রাস করতে পারে; উত্তরাধিকারী প্রাপ্তকারক–নিয়ন্ত্রণ–নেতার মনোবল শক্তিশালী করতে পারে। তবে—“সৃজনশীল সমাধান–স্বাধীনতা” রুদ্ধ হলে—জোট স্থিতিশীল হলেও “অর্থনৈতিক উদ্ভাবন–উন্নয়ন” বাঁধসাপেক্ষে থমকে যেতে পারে।
বৈশ্বিক প্রভাব ও ভারতের প্রেক্ষাপট
চীনের অস্থিরতা শুধুমাত্র নিজের অর্থনীতিতেই প্রভাব ফেলবে না—দেশ–বিদেশে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে:
🇮🇳 ভারতের জন্য সুযোগ:
- চীন–ভারতের সম্পর্কের উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হতে পারে।
- বিশ্বায়ন–ব্যাপার–সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগগুলো “চীন+১” স্ট্র্যাটেজির জন্য ভারতের দিকে ঝুঁকতে পারে।
- উদাহরণস্বরূপ—এখন-ই দেখতে পাচ্ছি অ্যাপল আইফোন উৎপাদন ভারতে বাড়ছে।
⚠️ চ্যালেঞ্জ:
- চীনের অর্থনৈতিক মন্দা–আর্থিক সংকট–বিশ্বব্যাপী মন্দা–পুঁজিপুঁজি–কমলা–রপ্তানি–নিয়ে খারাপ প্রভাব–ভারতে পড়তে পারে।
- চীনা পণ্য সস্তা হয়ে ভারতে ব্রতী—স্থানীয় উৎপাদকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
- রাজনৈতিক ভাবে—চীনার অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা বিদেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে (ব্যবহৃত “হুমকি-বর্ষণ” কৌশল)—যা সারাদেশে ও ভারতেও প্রভাব ফেলতে পারে।
ভারতের ভয়াবহ সতর্কবাণী
ভারতের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে—“চীন কী ভুল করে গেল!”—এই অধ্যায় থেকে:
- অটোগ্রাফিক–ডেটা ম্যানিপুলেশন, ভুল রিপোর্টিং, জনগণ–মার্কেট–অচেতনতা ক্ষতি করলো চীনের ভাবমূর্তি—ভারতের উচিত—স্বচ্ছতা ধরে রাখা, ডেটা সাবলীল প্রকাশ করা।
- যদিও ভারতে–যুব বেকারত্ব রয়েছে, তবুও—জনগন মত প্রকাশে স্বাধীনতা আছে; “উন্মুক্ত ডেটা” দ্বারা দেশের বৈশ্বিক আস্থা বৃদ্ধি করতে পারে।
উপসংহার
চীনের “শান্ত – সংকটোন্মুখ” অর্থনীতি—কাশে নাারার মতো আতঙ্ক—জনগণ সাসপেন্ড, বিনিয়োগ–প্রত্যাশায় আতঙ্ক—শিকার হয়েছে শি’র মৃদু কিন্তু স্পষ্ট সতর্কতায়। ভারতের জন্য—শিখনীয় অনেক দিশা রয়েছে।
জটে-ভরা, অথচ ইতিবাচক সম্ভাবনাময়—এক অনিশ্চিত চীন আজকের বিশ্বে চিহ্ন রাখছে। ভারতের সচেতনতা ও কৌশল নির্ধারণ করবে সামনের দশকে কীভাবে তা সুযোগে রূপান্তরিত হয়।
চীনা ভাষায় “সংকট” শব্দটি (危机) দুইটি চিহ্ন বহন করে—একটি বিপদের (危), অপরটি সম্ভাবনার (机)। শি জিনপিং-এর সংযত স্বীকারোক্তিগুলি—অর্থনৈতিক চাপে তিনি সরাসরি ‘সংকট’ বলেন না, বরং পরোক্ষভাবে বিপদের স্বীকৃতি দেন। এখন প্রশ্ন হলো—চীন কীভাবে এই সংকট সামাল দেবে? কারণ এখানেই লুকিয়ে আছে সেই সম্ভাবনা—নিজেদের সংস্কারের, এবং অন্যদের জন্য সুযোগের—যদি চীন শূন্যতা সৃষ্টি করে।
এখন পর্যন্ত শি জিনপিং-এর পন্থা হলো—নিয়ন্ত্রণ ও উদ্দীপনা দ্বিগুণ করা, যেন অর্থনীতি ‘নরম অবতরণ’ করে—কিন্তু মুখে “সংকট” শব্দটি উচ্চারণ না করেই। এটি একটি রশির উপর হাঁটার খেলা—খুব বেশি খোলামেলা কথা বললে সাধারণ মানুষ ভয় পাবে, আবার খুব কম প্রতিক্রিয়া দেখালে সমস্যাগুলি গাঁথা জমতে থাকবে।
‘চায়ের পাতায় ভবিষ্যৎ দেখা’র মতো অবস্থা
এই মুহূর্তে, পর্যবেক্ষকদের কাজ হলো—শির ছদ্মনামি ভাষা ও নীতিগত ঢেউপথ বিশ্লেষণ করা। কখনো তা রূপকথার উপমা, কখনো হঠাৎ নীতিমালার মোচড়, কখনো সংযত সুর—এসব থেকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে চীনের ভবিষ্যৎ পথচলা কেমন হতে যাচ্ছে।
এটি অনেকটা প্রাচীন চীনা অপেরার মতো—যেখানে চরিত্ররা সরাসরি কিছু বলেন না, বরং মৃদু অঙ্গভঙ্গি, চোখের ভাষা ও দৃষ্টির ঘূর্ণিতে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা প্রকাশ করেন। এই নাটকের দর্শক শুধু চীনের জনগণ নয়—পুরো বিশ্ব। এবং ভারতের উচিত হবে—এই থিয়েটারের প্রতিটি দৃশ্য গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা।
ভারতের জন্য সতর্কতা এবং সম্ভাবনার দ্বার
যদি ভারত সচেতন থাকে, তবে শুধু চীনের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারবে না, বরং চীনের ছায়ায় থেকেও নিজের আলোকিত পথ তৈরি করতে পারবে। কেননা, একটি যুগের ড্রাগন যদি হোঁচট খায়, তবে অন্যরা তাদের ডানা মেলবার সুযোগ পায়।
📌 আরও পড়ুন:
🗞️ কানাডায় খালিস্তান আন্দোলন: এখনই কেন ভারতের সরাসরি জবাব দেওয়া দরকার
এই প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ করা হয়েছে—কানাডার দ্বিচারিতা এবং কীভাবে বিদেশে পুষ্ট হওয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতি ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যেখানে চীনের অর্থনীতি ভিতর থেকে পচতে শুরু করেছে, সেখানে কানাডা বাহির থেকে বিশৃঙ্খলা রোপণ করছে।